ক্রীড়া ডেস্ক ॥ ইউরোপে বায়ার্ন মিউনিখ উড়ছিল। এমন কথাকে বাড়াবাড়ি বলার উপায় নেই। গত মৌসুমে সম্ভাব্য সব শিরোপা জেতা দলটি ৯০ মিনিটে বার্সেলোনাকে ৮ গোল দিয়েছিল। এবারও দুর্দান্ত প্রতাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে এসেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন সেই বায়ার্ন কাল ঘরের মাঠে পিএসজির কাছে ৩-২ গোলে হেরে বসেছে। কাল রাতে পাদপ্রদীপের আলো পুরোটাই ছিল কিলিয়ান এমবাপ্পের ওপর। না থাকার কারণ নেই। দুটি গোল করেছেন, গতির ঝড়ে বায়ার্নের রক্ষণকে পযুর্দস্ত করেছেন, বিশ্বের সেরা তারকাদের মধ্যে নিজের নামটা কেন আছে সেটা আরেকবার প্রমাণ করেছেন। এর মাঝে অনেকটাই আড়ালে রয়ে গেছেন কেইলর নাভাস। অথচ কাল এই গোলকিপার না থাকলে আধঘণ্টার মধ্যেই দুই গোলে এগিয়ে গিয়েও হয়তো হারতে হতো পিএসজিকে। গতকাল আক্রমণের দুই অস্ত্র ছাড়া নেমেছিল বায়ার্ন। চোটের কারণে আগ থেকেই ছিলেন না গত বছরের সেরা খেলোয়াড় রবার্ট লেভানডফস্কি। পোলিশ স্ট্রাইকারকে না পাওয়ার ধাক্কা মানসিকভাবে সামলে উঠেছে কি ওঠেনি বায়ার্ন, ম্যাচের এক দিন আগে পায় আরেক দুঃসংবাদ—করোনার ধাক্কায় ম্যাচটা থেকে ছিটকে গেছেন সার্জ নাব্রি। এ দুই ফরোয়ার্ডকে ছাড়া নামলেও আক্রমণের ঢেউ কিন্তু কমেনি বায়ার্নের। এমনিতেই ফান্সি ফ্লিকের বায়ার্ন প্রতিপক্ষের জন্য দম বন্ধ করা ফুটবল খেলে, কাল ২৭ মিনিটের মধ্যে দুই গোল খেয়ে রীতিমতো খেপে উঠেছিল। ২০১৯ সালের মার্চের পর থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে অপরাজিত বায়ার্ন। সে রেকর্ড অক্ষুণ্ন রাখতে কম চেষ্টা করেনি দলটি। মোট ৩১টি শট নিয়েছে, এর মধ্যে ১২টিই ছিল পিএসজির পোস্টে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র দুটি জাল ছুঁতে পেরেছে। আর বাকি ১০টিই ঠেকিয়ে দিয়েছেন নাভাস। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে ১০টি সেভ অবশ্য এর আগেও দেখা গেছে। সে কীর্তি যাঁর, তিনি কালও ছিলেন মাঠে, নাভাসের ঠিক বিপরীতে—মানুয়েল নয়্যার। ২০১৭ সালে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে ভয়ংকর ফর্মে থাকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে প্রায় একাই আটকে রেখেছিলেন বায়ার্ন গোলকিপার। ২০০৩/০৪ মৌসুমের পর তিনিই প্রথম কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ে ম্যাচে ১০টি সেভ করার কীর্তি গড়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ২০১৭ সালের সেই ম্যাচে সেদিন নয়্যারের উল্টো দিকে রিয়ালের পোস্টে ছিলেন এই নাভাসই। একদিক থেকে নাভাস নয়্যারের চেয়েও এগিয়ে। কারণ, অতিমানবীয় পারফরম্যান্সেও দলের হার ঠেকাতে পারেননি নয়্যার। কিন্তু কাল নাভাস ঠিকই তাতে সফল। অবশ্য নাভাসের জন্য এটা নতুন কিছু নয়। শেষ ষোলোর দ্বিতীয় লেগে পিএসজির মাঠে প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার আশায় বার্সেলোনা দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিল, তবু ১-১ গোলে ড্র মেনে নিয়ে ফিরতে হয়েছিল মেসিদের। কারণ, সেদিনও নাভাস নিজের ডাকনাম আবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। বার্সেলোনার বিপক্ষে নয়টি সেভ করেছিলেন এই কিপার। ওহ, তাঁর ডাকনামটা? স্পাইডারম্যান! নামটা রিয়ালে থাকার সময়েই জুটেছিল। রিয়ালের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের কৃতিত্ব ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কপালে জোটে। সের্হিও রামোস, করিম বেনজেমা বা কোচ জিনেদিন জিদানের নামটাও মনে পড়ে। কিন্তু কোস্টারিকান গোলকিপার তখনো আড়ালেই থাকতেন। লিগে টানা ৩৮ ম্যাচের পুরো সময়ই যে আস্থার প্রতিরূপ ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ এলেই মূর্তি বদলে যেত নাভাসের। রিয়ালের গোলকিপার বলে কথা! রিয়ালও তো চ্যাম্পিয়নস লিগে নামলেই অন্য ক্লাব হয়ে যায়! নাভাসও মহাগুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচে এমন সব সেভ করতেন যে অবিশ্বাস্য ঠেকত। ছোটখাটো গড়ন নিয়ে গোলবারের যেকোনো প্রান্তে তাঁর সেভ করার দক্ষতা দেখেই রিয়াল ড্রেসিংরুমে সতীর্থরা বলতেন, কেইলর এখন ‘স্পাইডারম্যান মুড’-এ আছেন। থিবো কোর্তোয়াকে কিনে নেওয়া রিয়াল মাদ্রিদ নাভাসকে ছেড়ে দিয়েছে গত মৌসুমের শুরুতে। দল বদলালেও নিজেকে বদলাননি নাভাস। এখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ এলেই সেরাটা বের করে আনেন। নাভাস দলে যোগ দেওয়ার প্রথম বছরেই ইতিহাসে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছে পিএসজি। এবারও যে ফর্মে আছেন, সেটা ধরে রাখতে পারলে কে জানে, হয়তো প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগও এনে দিতে পারবেন। ইউরোপে আক্রমণের দিক থেকে বায়ার্নের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো দল খুবই কম। তাদেরই যদি কেইলর আটকে দিতে পারেন, তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে আরও ভরসা পেতেই পারে পিএসজি। সন্দেহ নেই, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে পিএসজির এই অর্জনের মূল কারিগর হিসেবে নেইমার-এমবাপ্পের নামই বলা হবে। আড়ালে চলে যাবেন নাভাস। কিন্তু কোস্টারিকান এই স্পাইডারম্যানের এতে অভ্যাস হয়ে গেছে। স্পাইডারম্যানের মতো যে আড়ালেই থাকতে চান তিনি।
Leave a Reply